সংস্কৃত সাহিত্যে কবিতাকে প্রবন্ধ বলা হত । গদ্যে কবিতা লেখার চল বাংলায় নতুন কিছু না । গদ্য অপেক্ষাকৃত নবীন, ভেবে নেওয়া যায়, গদ্য সৃষ্টির আগে, অনেক আগে, যা গদ্যে বলা উচিত, যা গদ্যে বলা যায় – এমন সব কিছুই কবিতাতেই বলা হত । রামায়ণ, মহাভারত মূল থেকে অনেক অনুবাদ হয়েছে এবং সেগুলি গদ্যভাষায় হয়েছে । এই দুই মহাকাব্যের যে চিত্ররূপ টেলিভিশনে সম্প্রচারের জন্য নির্মিত হয়েছে, সেখানে কুশিলবরা গদ্যভাষাতেই কথা বলেন, কাব্যভাষা বা সরাসরি কবিতার ব্যবহার মূলের তুলনায় এখানে অনেক কম । এত সব কিছুর পরেও, একজন আধুনিক পাঠকের কাছে কবিতা ও গদ্য স্বতন্ত্র দুটি প্রকাশ মাধ্যম । একজন কবির কাজ কী ? একজন কবির কাজ হলো, গোপনতা রচনা করা । তিনি যা বলতে চান একজন পাঠক তার পুরোটাই ধরতে পারবে এমনটি প্রত্যাশিত নয় । অপরপক্ষে, একজন পাঠক নিজেও স্বাধীন পাঠে বিশ্বাস করেন । কবিতাটি কবির কোন মানসিক অবস্থার ফল, কি ঘটনার অনুপ্রেরণা কাজ করেছে কবিতাটি রচনার পেছনে এগুলি নিয়ে একজন পাঠক কখনোই চিন্তিত নয় । বিপরীতে একজন গদ্যশিল্পী, আরো বিশেষ করে উল্লেখ করলে, একজন প্রবন্ধ রচয়িতা নিজেকে (না, নিজের মেধাকে ?) মেলে ধরেন, প্রকাশ করেন । নিঃশ্বাসের শেষটুকু বায়ুর মতো, সে বের করে দিতে চায়, তার যা কিছু অর্জন । একজন কবি ও একজন প্রাবন্ধিক ভাষা ব্যবহারের দক্ষতায়, ভাষা ব্যবহারের মসৃণতায়, কখনো কখনো পাশাপাশি চলে এলেও, আসলে, দুজন দুজনের বৈপরীত্য রচনা করে চলেন ।
বীতশোক ভট্টাচার্য কবিতার মধ্যে রেখে দিতেন মেধার অনুশীলন, যেখানে তাঁর প্রবন্ধগুলির মধ্যে দেখা যায় কাব্যভাষার এক নান্দনিক ও শিল্পিত প্রয়োগ । কে বেশি এগিয়ে, কবি না প্রাবন্ধিক, সে আলোচনা এখনের বিষয় নয় । শুধু, এই দুই বিপরীত ধর্মকে, কিভাবে তিনি এক দেহে ধারণ করেছেন, মাঝে মাঝে এনে মিলিয়ে দিয়েছেন এক বিন্দুতে, সে দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা যতটা এখানের বিষয় । বিশ্বসাহিত্যে কবি-প্রাবন্ধিকের সংখ্যা অগণন, বাংলা সাহিত্যেও সে সংখ্যা খুব একটা অপ্রতুল নয় । তবু, প্রবন্ধের ভেতরে ভেতরে অবলীলায় ঘুরে বেড়ান কবি বীতশোক, কবিতার ভেতরে ভেতরে এক মেধাবী অন্বেষণ, যা আসলে প্রাবন্ধিক বীতশোকেরই নীরব উপস্থিতি, তারপরও তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধ, এই দুই মাধ্যম, দুয়ের জায়গায় স্থির ও স্বতন্ত্র । এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কবি-প্রাবন্ধিক বীতশোক ভট্টাচার্যকে বিচার করতে চাইলে তাঁর সঙ্গে হয়তো হাতে গোণা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে ।
তাঁর কবিতা লেখার ও কবিতা পড়ার নিজস্ব এক পদ্ধতি ছিল । হয়তো এক নয়, সঠিক শব্দটি হবে একাধীক, এই অগভীর পর্যবেক্ষণজনিত ত্রুটির দায় অকপটে স্বীকার করে নিয়ে বিষয়টিতে ফিরে আসছি । একজন কবি কিভাবে রচনা করেন, তা একান্তই তার নিজস্ব পদ্ধতি, নিজেকে জানা ও নিজেকে জানানোর জন্যই সে পদ্ধতি সৃজিত হয় । রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাজর্ষি উপন্যাসের পটভূমি স্বপ্নে পেয়েছিলেন, এবং এই কাহিনি শেষে এক কাব্যনাটকে এসে মুক্তি খুঁজেছিল, স্বপ্নতাড়িত একজন কবি, প্রেরণার বশবর্তী হয়ে, রচনা করেন (না, পেয়ে যান ?) কবিতার এক-একটি অমোঘ লাইন । রচনার সেই ক্ষণ, সেই স্বর্গীয় আনন্দ, আসলে বর্ণনার অতীত । স্বাভাবিক ভাবেই কবির রান্নাঘর সম্পূর্ণ মানসিক, উপকরণও সেখানে অ-মানসিক কোনো কিছু নয় । ফলে, একজন পাঠকের সুযোগ নেই, হয়তো প্রয়োজনও নেই, কবির রচনা পদ্ধতির সঙ্গে, সেই স্বর্গীয় আনন্দের সঙ্গে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জারিত হওয়ার । তারপরও, যে আহার সকলের রসনাকে তৃপ্ত করে , তার রন্ধনপ্রণালী সম্পর্কে জানতে চাওয়ার অধিকার সকলেরই আছে, আর সে অধিকারের গ্রহণযোগ্যতাও আছে । আধুনিক তত্ত্ববিশ্বে পাঠকের মর্যাদা বেড়েছে, এই শিল্পীত ভোজসভায় মাঝে মাঝে সে লেখকের আগের সারিতে এসেও বসে পড়তে পারে ! ‘রবীন্দ্রনাথ কেমন করে লিখতেন’, এই বিষয়ে ও শিরোনামে, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থও রচনা করেন । একজন আধুনিক পাঠক, জীবনানন্দের বনলতা সেন পাঠের সঙ্গে সঙ্গে সেই কবিতার একাধীক ড্রাফট পড়তে পেরেছে, কবির নিষ্ঠাটুকু চিনে নিতে নিতে তাঁর রান্নাঘরের ভেতর থেকেও ঘুরে আসতে পেরেছে অবলীলায় ।
বীতশোক ভট্টাচার্য কিভাবে কবিতা পড়তেন তা আজ আর আমাদের অজানা নয় । তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থে কবিতা-পরিচয় শিরোনামে বিভিন্ন কবিতার পাঠপদ্ধতি গ্রন্থিত হয়েছে । সুতরাং শুধু লেখা নয়, কবিতা পড়তেও জানতে হয় । সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলি, বোধহয় এত জোরালো ভাবে, একজন দীক্ষিত পাঠকের প্রত্যাশা করে না । বীতশোক ভট্টাচার্যের কবিতা পড়ার পদ্ধতি থেকে তাঁর রচনাপদ্ধতি কিছুটা আঁচ করে নেওয়া যায় । এই প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত ঘটনার কথা মনে পড়ছে । মেদিনীপুর কলেজে পড়াকালীন একবার ডিপার্টমেন্টের ট্যুরে মুকুটমণিপুর যাওয়া হয়েছিল । সেখানের নদী, বোটিং, মহিলাদের হস্তনির্মিত কাঠের জিনিশপত্র স্মৃতিবাহিত হয়ে ধরা পড়েছিল আমার একটি কবিতায় । তখন মাঝে মাঝেই সেই সব কবিতা বীতশোকবাবুকে দেখাতাম (কলেজে অশোকবাবু নামে পরিচিত ছিলেন, এবং কলেজ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে অশোক ভট্টাচার্য নামটিই ব্যবহার করতেন । বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা এ.বি. নামে চিনলেও আমরা কয়েকজন বীতশোকবাবু নামেই ডাকতাম ) । অফ পিরিয়ডে লাইব্রেরীর রিডিংরুমে গিয়ে, গভীর ধৈর্য সহকারে, আমার সেই কাঁচা হাতের লেখা কবিতাগুলি পড়ে দেখতেন, প্রয়োজনে শুধরে দিতেন । ছোটখাটো পরামর্শ দিতেন । কিছু কিছু শব্দের কথা বলতেন, বা আমার কবিতায় ব্যবহৃত হলে সেগুলি চিনিয়ে দিতেন, যেগুলি আর বাংলা কবিতায় ব্যবহার না করাই ভালো, উনি বলতেন । একদিন, মুকুটমণিপুর কবিতাটা স্যরকে পড়তে দিই । কবিতার মধ্যে দুটি লাইন ছিলো এরকম — ‘পুরুষগুলির একটি ডিঙি, নদিই ওদের ঘর / নারীরা সব কাঠের কাজে, রাতের কাজে বর ’ । সম্পূর্ণ কবিতাটা পড়ার পর, ‘রাতের কাজে বর’ এর কাজে শব্দটির নিচে দাগ দিলেন । বানানের ভুল, বা অন্য যেকোনো রকমের ভুল নির্দেশের জন্য উপযুক্ত স্থানে তিনি আলতো একটি দাগ টেনে দিতেন । তখন মনে হয়েছিল, পর পর দু’বার ‘কাজে’ শব্দের ব্যবহার হয়তো ওঁনার ভালো লাগে নি । কিংবা, এই শব্দটির দ্বিতীয়প্রয়োগে সরাসরি যৌনতার যে অনুষঙ্গ নিয়ে আসা হয়েছে, তা বিষয়টিকে হয়তো অনেকটাই হালকা (উনি ব্যবহার করতেন ‘তরল’ শব্দটি ) করে দিয়েছে । উনি বললেন, এখানে দারুণ শব্দটি ব্যবহার করতে পারো, রাতে দারুণ বর… । আমার ‘দারুণ’ শব্দটিকে কবিতায় প্রযুক্ত হওয়ার মতো খুব একটা দারুণ শব্দ বলে কখনোই মনে হয়নি । ধরিয়ে দিলেন, দারুণ শব্দটির মধ্যে দারু অর্থাৎ কাঠের অনুষঙ্গটিও রয়ে গেছে । পরামর্শ বলতে এটুকুই, মিতভাষী এই মানুষটি কখনোই এর বেশি এগোতেন না, বাকিটা বুঝে নিতে হতো । নারীরা সব কাঠের কাজে, রাতে দারুণ বর । সেদিন বুঝেছিলাম, কেন এই কবিতার জন্য, ‘কাজে’ শব্দটি ততটা দারুণ নয়, ‘দারুণ’ শব্দটি যতটা কাজের । একটিমাত্র শব্দের প্রয়োগ কিভাবে একটি লাইনের, কখনো একটি সম্পূর্ণ কবিতার পরিসর কে অনেক অসীম, অনেক ব্যপ্ত করে তুলতে পারে, আমি লক্ষ্য করলাম । তিনি কিভাবে একটি কবিতা পড়েন, এখান থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে যায় । তিনি কিভাবে লেখেন সেটিও আর অধরা রইলো না একজন পাঠকের কাছে । একটি শব্দের শ্রুতিমধুরতা নয়, এমন-কি একটি শব্দের কাব্যিকতাও নয়, কবিতাটিকে আরো বেশি গভীর, আরো বেশি ব্যঞ্জনাবহুল করে তোলার জন্য তিনি এমন শব্দের ব্যবহার সমর্থন করতেন যার মধ্যে বহু অর্থের দ্যোতনা রয়ে যায় । এমন অনেক শব্দ তাঁর বিভিন্ন কবিতায় পাওয়া যাবে, যেগুলি প্রাচীন, অব্যবহৃত বা বাংলা কবিতায় প্রথমবারের মতো প্রযুক্ত হলো, এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির দ্বিতীয় ব্যবহারের আর হয়তো কোনো সুযোগ থাকলো না । প্রত্যেক কবির-ই নিজস্ব একটি শব্দ ভাণ্ডার থাকে । কবির সচরাচর ব্যবহৃত শব্দগুলি নিয়েই গড়ে ওঠে সেই ভাণ্ডার, আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যোগ বিয়োগের খেলাও চলতে থাকে নিরন্তর । একজন বড় কবির এই ভাণ্ডার সবসময়ের জন্য পরিপুষ্ট হয় । বীতশোক ভট্টাচার্যের শব্দভাণ্ডারটি বিভিন্ন আঙ্গিকের শব্দে পরিপূর্ণ ছিল । তিনি বাংলাকবিতার অভিধানে অনেক নতুন শব্দ ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এবং পেরেছিলেন । তাঁর যেকোনো একটি কবিতার বই খুলে বসলে এমন অনেক নতুন শব্দের দেখা পাওয়া যাবে ।
- …পুঙ্খাতিশেষ / উপড়ে তুলেছি; বেশ, মরণের এ উচ্চারণ / তুমি নাও দেখি । (স্বরাঘাত)
- শিলাজতু এক কুমারী থাকে ওইখানে, / সমুদ্র তাকে মেঘ-মৃদঙ্গের শব্দ শোনায়, আর , দেবদাসী / সে, ফেনায় ফিরিয়ে দেয় চন্দন রঙের চুম্বন । ( ক্রিটদেশীয় নাবিকের দিনলিপি থেকে)
- … উত্তানশয়িত দেখে / আমার চিলুতে / বিঁধে যায়, পোড়া কাঠ, আকাশ আমাকে সঙ্গে নেবে (জাতক)
- হাতশুদ্ধ থেমে আছে আভালাঁশ, আজ ধুলোট তোমার / পুঁথির স্থগিত পাতা, ওড়ে শীত / ক্ষণজীবী পতঙ্গেরা ওড়ে, (একদা)
- শূন্য না সান্নিধ্য । আমি এমনিধারা ধাঁধা / ব্রহ্মোদ্যপ্রতিম গেঁথে তোমার কাছে গেছি । (ভ্রান্তিমান)
এখানে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত, ‘শিল্প’ কাব্যগ্রন্থটি থেকে উপরের পাঁচটি উদাহরণ নেওয়া হলো । শুধু এই কবিতার বইটির ক্ষেত্রেই নয়, তাঁর সমগ্র কাব্যসংগ্রহ জুড়ে এমন অনেক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । তাঁর অনেক কবিতাই সাধারণ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হওয়ার পেছনে এটিও একটি অন্যতম কারণ বলেই মনে হয় । কিন্তু সেই সঙ্গে এটিও স্বীকার করে নেওয়া উচিত, যে, বিভিন্ন আঙ্গিকের শব্দ ক্রমাগত কবিতার পরিমণ্ডলে নিয়ে আসার জন্য কবিকে যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়, নিরাসক্ত হতে হয় । অনেক কবিই আছেন যারা সামান্য কিছু শব্দের ঘেরাটোপে সারাজীবন কাটিয়ে দেন , বীতশোক ভট্টাচার্য তাদের দলে পড়েন না ।
তাঁর গদ্যভাষা অনেকটাই তাঁর কবিতার ভাষার কাছাকাছি যেতে চায় । যে বিষয় একটি প্রবন্ধের দাবী করে, তিনি তা কবিতার বিষয় করে তুলতে পারেন । ভাবগত দিক দিয়ে, গদ্য এবং কবিতা একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যায়, আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র দুই মাধ্যম হলেও এদের অন্তঃলীন আদানপ্রদানের ইতিহাসটিও খুব পরিপুষ্ট । কাব্যে নাটক লেখা হয়, কাব্যোপন্যাস বাংলাতেও রচিত হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার বইয়ের নাম রাখেন ‘কথা ও কাহিনি’ যেখানে ‘শেষের কবিতা’ একটি উপন্যাসের নাম । দেশি বিদেশি সাহিত্যের আগ্রহী ও মেধাবী পাঠক বীতশোক ভট্টাচার্য এসকল ঘটনার সুদূর এক তাৎপর্য নির্মাণে সক্ষম, এবং সেজন্যই হয়তো প্রবন্ধের বিষয় কেন কবিতায় ধরে দেওয়া হবে, কিংবা আদৌ ধরে দেওয়া উচিত কিনা এসকল ভাবনা তাঁর কাছে নতুন কোনো বিতর্কের বিষয় নয় আর ।
আজ আমরা পড়ব এই ‘শ্রাবণে’ কবিতাটি । শ্রাবণ নয় মনে রাখবে এই কবিতার নাম : মানে, যদিও জলছবি বাংলার দেশগ্রামের, তবু ভূপ্রকৃতি জলে জলময় শেষ কথা নয় আর । আর, পটভূমি এঁকেছেন কী কবি । একুশে জুলাই এগারোটায় ক্লাসঘরে এক অবাক অন্ধকার । এখন লক্ষ করো দৃষ্টিকোণ : এই কবিতার কোথার থেকে শুরু : —না, কবি তাঁর জানলা থেকে; তারপর তো ক্যামেরা স’রে যায় গাছপালা ঘাস ছায়ার থেকে, দিঘি ও পথ, খেত আর ছায়াতরু, মাঠের শেষে যেখানে প্রায় অন্ধকার । পটভূমিকা শূন্যতা সাজায় । সানশেডে চোখ আটকেছে, এই অসম্ভব এক মেঘলা আবিষ্কার । মনে হবে কবিতাটির রচনারীতি শিথিল । খুবই চেনা জানা ঘরোয়া সব শব্দ নিয়ে আটপৌরে লেখা । ঘাসে / আকাশে মিল এই এইরকমই শাদামাটা এমন ছ-টা স্তবক । তবে এত সহজ না স্বভাবোক্তি, শক্ত ভীষণ । জোড়া এবং ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলো মিলেই … হঠাৎ গলা ডুবিয়ে দিল ঝমঝমে আর চপলতম তারস্বর কার । দাঁড়াও, থামো । সুন্দর এই কবিতা আর একটু খানিক বাকি— ফ্রেমে যেমন ছবি, তেমনি এ বর্ণনা কবির যেটা মেজাজ ধরে রাখার আধার মাত্র : মন খারাপ আর কাজ না করা, ফাঁকি শুধু কী আর ছাত্ররা দেয় । বেশ একটানা আলোচনা আজ হচ্ছিল, শেষ কখন হলো বোঝা গেল না ‘শ্রাবণে’ কবিতাটি ।( ক্লাস-ঘরে কবিতা )
কবিতা সংগ্রহে অগ্রন্থিত কবিতা-র (পৃষ্ঠা ৩০২) মধ্য থেকে তুলে নেওয়া এই কবিতাটি, না কাব্যে লেখা এই প্রবন্ধটি ? আরো কয়েক পৃষ্ঠা এগিয়ে এসে ২৭৭ পৃষ্ঠায় ‘দেশরাগ’ কবিতাটিও একই ভাবে পড়া যেতে পারে । পড়া যেতে পারে আরো এখানে ওখানে থেকে যাওয়া এ ধরনের অনেক কবিতা । কবি ও প্রাবন্ধিক পরস্পরের বৈপরীত্য রচনা করে চলে এমনই ভেবে নেওয়া হয়েছিল যেখানে, প্রকৃতপ্রস্তাবে সেই ধারণারই বিপরীতে এসে দাঁড়ালেন বীতশোক ভট্টাচার্য । তাই কোনো কথাই শেষ কথা নয় শেষপর্যন্ত ।
“একার কোনো কথাই এখন আর একোক্তি নয়, স্বাশ্রয়ী বিশ্লেষণের বিষয় নয় আর কোনো কথন । যখন ভাবা হচ্ছে আপন প্রাণের শক্তিতে পূর্ণ হয়ে কোনো কণ্ঠ এই একান্তে উৎসারিত হল, তার ঠিক আগেই সে-কণ্ঠকে নিবিড় ঘিরে ধরেছে প্রতিযোগী এমনকি বিপ্রতীপ উচ্চারণের ভিড় । যা আক্ষরিক অর্থে অতীত বলে জানা হয়ে গিয়েছিল যে বিগত কালকে, রূপকার সে-অতীত ভাষায়— ভাববিগ্রহের চেয়ে বাক্প্রতিমায়—মূর্তি দিতে দক্ষ । সমুদ্রের ঢেউএ ঢেউএ ভেসে-আসতে-থাকা কাঠেই তো জগন্নাথের নবনবীন কলেবরের দারুণ তক্ষণ ।”
তাঁর পূর্বাপর (২০০৬) গ্রন্থের এই ভূমিকাটি পড়লে বোঝা যায় কবিতা লেখা ও পড়ার যে পদ্ধতি তিনি ব্যবহার করতেন, তা তাঁর গদ্যের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য ।
‘…যত কালো গর্তেই ঠেশে / ধরা হোক, তবু একটি মুখের আলো / নিববে না …’ (নতুন কবিতা) …কালো এবং আলো’র সমান ও বিপরীত মিলে গড়ে ওঠা এই পঙক্তিগুলো আসলে কালোর কথা বলে না, আলোর কথাও বলে না, যতটা তাঁর, বীতশোক ভট্টাচার্যের, বিশ্বাসের কথা বলে । এই আশা, এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি সারাজীবন কবিতা লিখে গেছেন । কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় ছিল, বীতশোক নামটিও সুভাষ মুখোপাধ্যায় দিয়েছিলেন, এবং বাংলা কবিতা উৎসবে (বাংলা আকাদেমি, ৭ ডিসেম্বর ২০০৫) তাঁর বক্তব্যের বিষয় ‘সন্ত্রাস ও কবিতা’ হলেও, বীতশোক ভট্টাচার্য যুদ্ধের কবিতা লেখেন নি, প্রতিবাদের কবিতা বা বিপ্লবের কবিতাও লেখেন নি । ভারতসংস্কৃতির মৌল যে রূপটিকে তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, বা যেভাবে তার বিনির্মাণ (এখানে মনে রাখতে হবে, ডিকনস্ট্রাকশনের সঠিক বাংলাটি হল অবিনির্মাণ, বিনির্মাণ নয় ) করতে চেয়েছিলেন, সেটির যথার্থ প্রকাশ যুদ্ধে নয়, প্রতিবাদে বা বিপ্লবে নয় বরং অনেকবেশি আধ্যাত্মিকতায় । আধ্যাত্মিকতার একটি চোরা শ্রোত তাঁর কবিতাগুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় । একজন জেনসাধকের মতো, তাঁর কবিতার যাত্রাও আসলে শুদ্ধতার দিকে, স্তব্ধতার দিকেও । আবার এই লেখাটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ যেমন ঘুরেফিরে এসেছে, বীতশোক ভট্টাচার্যের বিভিন্ন লেখাতেও রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ খুব জোরালো ভাবেই এসেছে । মার্ক্স-ফ্রয়েড-নীৎসে-জেন-কিয়ের্কেগার্দ এর প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, জীবনানন্দ যেমন এসেছেন , রবীন্দ্রনাথও এসেছেন, যেন একটু বেশি মাত্রাতেই এসেছেন । বীতশোক ভট্টাচার্যের বিভিন্ন প্রবন্ধে-কবিতায় রবীন্দ্রনাথের এই একটু বেশিমাত্রায় চলে আসা আমাদের মনে করিয়ে দিতে পারে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় আধ্যাত্মিকতার একটু বেশি মাত্রায় চলে আসার কথা । যেন সমগ্র রবীন্দ্রনাথ নয়, আধ্যাত্মিক রবীন্দ্রনাথকেই মেনে নিয়েছিলেন উনি, গ্রহণ করেছিলেন উনি । রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থও রচনা করেছেন, ‘পুরাণপ্রতিমায় রবীন্দ্রনাথ’ । জীবনানন্দ ব্যতীত আর কোনো বাঙালি কবিকে নিয়ে তিনি এভাবে গ্রন্থ রচনা করেন নি ।
তিনি শুধু যে বাংলা কবিতা রচনা করতে চেয়েছিলেন তা নয়, তিনি বাঙালির কবিতা রচনা করতে চেয়েছিলেন । বাঙলায় লেখা কবিতা মানেই যে বাঙালির কবিতা নয়, এবং বীতশোক ভট্টাচার্যের মত একজন কবি ও চিন্তকের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে এধরনের বিরোধাভাসের উল্লেখের প্রয়োজন হয়ে পড়বে, তা আজ আর আমাদের মধ্যে নতুন কোনো বিস্ময়ের উদ্রেক করে না । পশ্চিমের পোস্ট মডার্নিটি এবং বাঙালির উত্তর আধুনিকতা যে ভাবনাগত ও প্রকরণগত দিক দিয়ে বিস্তর আলাদা, গ্লোবালাইজেশন এর সুন্দর একটি বাংলা বিশ্বায়ন হলেও, আমরা বাঙালিরা সহজে ও সচ্ছন্দে যে তার আওতায় চলে আসতে পারিনা, এই প্রয়োজনীয় সত্যগুলিকে অনুভব করার দরকার আছে এবং স্বীকার করে নেওয়ার দরকার আছে । উত্তর আধুনিকতা চর্চার নামে, পোস্ট মডার্নিটির ভ্রান্ত অনুকরণে প্রচারসর্বস্য যে সাহিত্য গড়ে উঠছে তার ভাষাটি বাঙলা হলেও, তার সঙ্গে বাঙালির মনন ও মানসিকতার কোনো যোগ নেই বললেই চলে । হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাস ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়, আর বীতশোক ভট্টাচার্যের কবিতা হলো সেই ইতিহাসেরই অগ্রসরণ, সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন শেকড়হীন কোনো ভাবনাবিলাশ নয় । এই প্রসঙ্গে কবীর সুমনের একটি কথা খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়, সবাই যখন বেসুরো সেইসময় সুরে বেজে ওঠাও একটি প্রতিবাদ । আমাদের বাংলাভাষায় এই সুরে বেজে ওঠার কাজটি যে-কয়েকজন সারাজীবন নীরবে চালিয়ে গেছেন, বীতশোক ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন, এ বিষয়ে আজ আর কোনো সন্দেহ নেই।
বীতশোক ভট্টাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
অনেক স্বর্ণাভ পাখি
অনেক স্বর্ণাভ পাখি আমাদের গৃহদ্বারে সন্ধ্যায় এসেছে; তাদের সুতীক্ষ্ণ চঞ্চু অতর্কিত আক্রমণ পিত্তলে বাঁধানো; দানব শৃঙ্খল খুলে দিলে যারা মূঢ় জন্তু স্বপ্নের উপরে উঠে আসে, ছিঁড়ে খায়; তেমনও মাংসাশী নয়, সুবর্ণের তেজে তাদের সমস্ত পাখা পুড়ে যায় । এই জ্যোতির্ময় ডানা এখন সহজে লুকোনো সম্ভব নয়…মনে পড়ে শিকারের বাজপাখি ঘরে একদা এনেছি রেখে, অন্ধকারে ভালো থাকে তাদের বানানো অন্যূন হিংস্রতাগুলি; অথচ স্বর্ণাভ পাখি, তোমরা এলে যে, নাগরিকতার শান্তি, তোমরা কিছু কী তার —কতটুকু জানো ?(অন্যযুগের সখা । ১৯৯১)
এই শূন্যতার মানে
একটি অপ্সরা এসে নেমে গিয়েছিল তার মুখের হৃদয়ে :
এইখানে ভালো থাকি আমি কিছু কাল ধরে, আমি এইখানে প্রস্তরভূতার মতো শ্যামরঙে মাখা থাকি; শান্ত, স্তব্ধ হয়ে অথচ বেদনা কেন পেতে হল… যে পাথর পৃথিবীর টানে কেবলি তরঙ্গাহত হয়ে হয়ে যেতে চায়, মিথ্যে পরিচয়ে বা কেন সে স্থিরতর, যেরকম জলতলে আলোর আহ্বানে পড়ে থাকে রাঙা মৃত্যু, নিস্পন্দ ওসব নুড়ি; বিকেলের ভয়ে শূন্য হতে চেয়ে এই অপ্সরার অভিব্যক্তি; স্বপ্নের অজ্ঞানে ডুবেছে জাতক তার, সে কী খুঁজে পেল এই শূন্যতার মানে !(অন্যযুগের সখা । ১৯৯১)
শিল্প
নিষ্ফলতাভারানত নেমে আসে তোমাদের হাত ।
রাত্রি, এই দেশে … ফলের ভিতর ছাই, নেই তাই অপেক্ষার নাম — ফেনাশীল ধৈর্যের আক্রোশ ; পাতায় পাতায় সন্ধে । নয়, না তো, কেবলই বিদায় ঠেলে চলে যেতে যেতে ঠিক এই বীথিকার রূপ : নিচের কিছুটা সিসে আর ভারী নেমেছে প্রদোষে চুম্বনের বিকীর্ণ গন্ধক ; সরো অতিব্যক্ত স্মৃতি, সরো ঠোঁট, লঘুতর ঝরানো পর্ণালি ; জানো তো পদ্মের কেন্দ্রে পদ্ম নেই, প্রশান্তি অথচ জানো তো কেন্দ্রের পদ্মে বুদ্ধ নেই, প্রশান্তি অথচ জানো যে জানো না … ঝরে লবণান্ধ জল, দীর্ঘাকাশ মজা ছায়া জমাট প্রত্যাশা— হিরণ তারার কণা এসো আরও অন্ধ করো অপ্রতিফলিত । তারপর প্রৌঢ়তার গল্প রাত ভরে ; সরালে পাথর কত অথচ পাথর ছিল, ছন্দে থেকে সরেছ কত যে আচ্ছন্নতা থেকে গেল তবু ; আর দীর্ঘ দীর্ঘ গাছ, আরও রোগা করাঙ্গুলি বাড়াতে বাড়াতে থেমে গেল রাত্রি, স্তব্ধতায় ।(শিল্প । ১৯৮৬)
একটি বিম্বিত অশ্রু
একটি বিম্বিত অশ্রু প্রতিশ্রুতিময় হয়ে দর্পণে জেগেছে ;
কী দুঃখে সে মুছে যাবে ? যত সব হেমন্তের নিশ্বাস আয়নায় মন্থর স্বচ্ছতা নিয়ে যদি ক্রমে চলে যায়, সে তার অভ্যাসে স্থিত মুখশ্রীর মত প্রত্যর্পিত হয়ে রবে, নিজস্ব নকশায় তুষারকণার চেয়ে একাকিত্বে অহংকারে, এ সৌন্দর্য সে যে দ্যাখে নি কখনো কোনও গোলাপের পুষ্পাধারে ; পর্ণ ঝরে যায় যেন এক রমণীর নিরলন্ব কানপাশা, রহস্যের থেকে যে পোশাক ঝরে যায় তারও এ শরীর নেই, তাই তো সে জেগে জেগে জেগে বসে আছে, হৃদয় স্পন্দিত এক টলটলে স্তর রেখেছে উন্মুখ করে, দর্পণ আর কী পাবে লোভন চুম্বন ।(শিল্প । ১৯৮৬)
এসেছি জলের কাছে
এসেছি জলের কাছে পীড়িত খরার দেশ থেকে ।
যেখানে চোখের কালো মণি থাকে এখন সেখানে কাজললতার মতো এক নদী খুলে যায় ; পথের দুধারে পাথর মেঘের স্তূপ ; প্রতিধ্বনি থেমে গেল বিস্তৃত দুপারে । দেখা যায় হাল পড়ে, স্তব্ধ চাপা ভাটিয়ালি দীর্ঘ গুণ টানে । মেটেবুরুজের মতো থমথমে কে কিশোর, আমি তাকে দেখে হঠাৎ ডাকতে যাব, আর অমনি অসিতাভ অনেক কিশোর অনেক নৌকায়, আর প্রত্যেকেই হেরে যাবে যেন এই বাচে এত দ্রুত যায় আজ । দুপাশের ঢেউ চুপ ; ফিরে তাকায় না কেউ আর আমার দিকে ; আমার বিয়ের দিন যে হাত-আয়না মসৃণ দেখাতে গিয়ে সিঁদুরচর্চিত মুখ বাষ্পে শ্বাসে কাচে ঠেকে গিয়েছিল আজ জলকিশোরেরা তারও চেয়ে বেশি নিরুত্তর ।(এসেছি জলের কাছে । ১৩৯৩)
কাকে বেশি ভালো লাগবে
কাকে বেশি ভালো লাগবে : তোমায়, না এমন বর্ষাকে ।
উত্তর দেবে না তুমি । ধর্তব্যের মধ্যেও ধরবে না যে এমন প্রশ্ন করে । মনে রেখো তবু অবশ্যই ওকথা জিজ্ঞাসা করলে বিশ্বাস পুঞ্জিত থরেথরে, মেঘের ওপারবর্তী মেঘস্তর ভেদ ক’রে আলো হতে থাকে : তোমার চোখের মণি যেন ঝকঝকে ভেজা, তার অভ্যন্তরে অনৃতের আভা আছে । যা কিছু খসানো, ভ্রষ্ট, সব যদি ওই মোটা ফোঁটা হয়ে নামে তা হলে কী মনে হবে তুমি সাশ্রুতমা মিথ্যার মর্মের কাছে বসে আছ । সরে যাও চিকণ, মসৃণ পাতায় কামড়ে-থাকা সজলতা ; জ্ঞানপাপ বুঝি সরে যায় আরো বিষণ্ণতা এলে । যখন একলা নয়, তখনও একাকী । বিকেল ফুরিয়ে গেল, অনিঃশেষ হয়ে আছে বৃষ্টিধোয়া দিন ; ঈশ্বরের দিকে গিয়ে ঘুরে ফিরে চলে আসছে একটা চিলপাখি ; আমি ইতস্তত করি বর্ষাকেও স্থান দিতে এই কবিতায় ।(এসেছি জলের কাছে । ১৩৯৩)
যাত্রা
পাতার ওপর রোদ পড়েছে, পাতার ওপর ছায়া ;
মাটির ওপর নকশা আছে মেলা : গাঁ পেরিয়ে মেলায় এসে মেয়েরা যেন আহা গলা জড়িয়ে কাঁদছে বিকেলবেলা । কাঁপছে ছায়া, থামবে কেঁপে শেষ বিকেলের আলো ; অন্ধকারে নদীতে আর নদীতে হবে দেখা ; অন্ধকারে বোনকে ছেড়ে বোন রে কাঁদিস না লো । একলা চলে শালের বন ঝিঁঝিঁর ডাকে একা ।(দ্বিরাগমন । ১৯৯৭ )
দেখা
প্রথম তারার আলো এসে পড়ে মুখে ।
এইবার ওঠো, বাড়ি ফেরো । ও তারাটি ছিল । নেই । তার আলো শূন্যতার বুকে : উৎস আছে এই রহস্যেরও । তোমার রহস্য নেই । নেই কোনো আলোর বছর । মুখ তোলো, চাও চোখে চোখে : যেন দূর থেকে একা আলোরেখা এল, তারপর মেলাবে না আর শূন্যলোকে ।(দ্বিরাগমন । ১৯৯৭ )
পাত্রী
মেয়েটির কিছু নেই, মেয়েটি এগিয়ে দিল মুখ ;
এই নাও বোবা মুখ ; এই মুখ যন্ত্রের, জন্তুর । উৎকন্ঠ উদ্গ্রীব ছেলে, ধরে ধরে পড়ল সে অবাক চুমুর ছুঁয়ে-চলা অন্ধ-লিপি ; চোখ, গাল, গলা, ফের প্রথম চিবুক । মেয়েটির কিছু নেই, মেয়েটি এগিয়ে দিল বুক ; নাও এ দুঃখের ভরা, এই শরা তামারঙ, ঠাণ্ডা আর ছোটো ; ছেলেটির তেষ্টা, খিদে : দুটো হাতে, ফাটা ঠোঁটে ওর শুষে নিল কাদা জল রক্ত লবণাক্ত সেই প্রথম চুমুক ।( দ্বিরাগমন । ১৯৯৭ )
পদাবলী
উৎকল এক পদ ভেঙে এই দধিমঙ্গল গান :
গোয়ালিনি তাঁরা সার বেঁধে যান, আশরীর টানটান ; আর সকলের মাথায় বসানো এক এক পূর্ণ ঘট । চলনে দ্রুততা, ঘট নড়ছে না, পিছনে হটছে পথ । যিনি সখীদের সামনে চলেন ক্ষিপ্রাকিশোরী রাই । ভরা ঘট নাকি রাধার শরীর : কে যে কাকে সামলায় । হঠাৎ কী এসে পাশে থেমে গেল গোধূলিরঙিন ঝড় । কে যে তাঁরা, নন ব্রজের রাখাল পরিহাসতৎপর । কংসের কর জোর ক’রে নিত অবিনীত ঘাটোয়াল ; সে তো নেই; আর বৃন্দেদূতী যে ফিরেছেই গতকাল । ঘাড় না ফিরিয়ে আড়চোখে পুরো দেখতে পেলেন রাই ; লহমায় ঘোড়া থামাতে শিখেছে মথুরার শ্যাম রায় । চোখে তৃষা আর বক্ষে পিপাসা : ‘কই দুধ, দই কই ?’ স্থির ব’সে, তাঁর হাত বাড়ালেন কৃষ্ণ অশ্বারোহী । ভাণ্ডসমেত রাধিকার হাতে ঠেকল না—অদ্ভুত ! পাণ্ডু-আলোয় ভেঙে ভেসে গেল মুখ বুক দই দুধ ।(নতুন কবিতা । ১৯৯২)
হারমোনিয়াম
তোমার নিজের মাকে তোমার আজ ভালো মনে নেই ।
এইটুকু মনে আছে একবার বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে উঠোনের দিকে চেয়ে, একবার বিকেলের আকাশের দিকে তারপর তোমার ওই মুখের ওপাশে চেয়ে গান গেয়েছিল : ভেঙেছে চাঁদের হাসি …তারপর থেকে সেই আলো উছলে পড়ে মায়ের দুঠোঁট ভরে উঠেছিল, ফুটেছিল চোখে ঝিকিমিকি তুমি তা দেখেছ নাকি না দেখেই চেয়ে থেকে হাসি-হাসি মুখে দেখেছ মায়ের হাত বেলো করে তোমার ও আঙুলের একটু ওপরে আলতো আঘাত করে, তারপরে আর কিছু তত মনে নেই । মায়ের পরনে ছিল ফুলফুল নীল শাড়ি, তবে তাও ভুল হতে পারে : স্মৃতিটুকু থেকে গেছে, আলতো আঘাত ঝরে চোখ মুখ নাকের ওপরে ।(নতুন কবিতা । ১৯৯২)
বিচার
রাত অবসান হলো সেই বন্দীর ।
গোপনেও কাউকে সে জানাতে পারেনি কোনোদিন : কই তার বিচার, কী তার অপরাধ, কেন এই শাস্তি । শুধু এই দণ্ডে সে জানে তার দণ্ডিত হওয়ার প্রস্তুতি বস্তুত শুরু হয়েছে মধ্যরাত্রে কেউ যেন তার মর্মকোষে ঢেলে দিয়েছে বিষ । ক্রমশ উদ্ভিন্ন হয়ে-ওঠা সেই গরলফুল ফুটে উঠেছে গারদের পাথরে, লতিয়ে গিয়েছে লোহার গরাদে । এবং-অথচ দুঃস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠতে উঠতে তার বোধ হয়েছে : অগোচর সে সুরভির উৎস আর অন্য কোথাও নেই— আছে কথা-নেই সে-স্বপ্নের মধ্যে । তাই এই ভোর-রাত্রে ধূসরাভ এ আকাশ থেকে অপর্যাপ্ত দুধের যে ধারা নামছে তা পর্যাপ্তভাবে ধারণ করবার কোনো পাত্র নেই; নেই উচ্ছলিত হয়ে পড়বার কোনো শব্দও । এই মাধুর্য জীবনের, এবং-অথবা মৃত্যুর ।(বসন্তের এই গান । ২০০১)
সম্ভাষণ
এমন অশব্দ
মূক সন্তানের দিকে চেয়ে-থাকা মৌন মায়ের আকাঙ্ক্ষা যেরকম কার প্রতি তোমার এই সম্ভাষণ । অরব বলন কেবলই উৎপীড়ন করছে প্রীতিবশত গভীরতম চোখ দুটো । কারও চোখের তলায় কালি, কারও চোখের তলে অঙ্গার । শ্যামলা গাভীর দুটো চোখ এত অবোধ্য ঢুকে পড়ছে চান্দ্রায়ণ-ব্রতীর আত্মার মধ্যে । কাকে অধীকার করে নিচ্ছে অন্ধকারের শিখা । নিরস্থি আগুনের জিভ কাকে অধিকার করে দিচ্ছ ভেতরে-ভেতরে । বাইরে যেন কোনো সন্ধান নেই, সন্ধি নেই কারও সঙ্গে । একলা এক ঘোড়ার সওয়ার উপকথার এক একলা রাজপুত্র একের পর এক পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে একের পর এক পাথরের ঘাট বেয়ে উঠে আসছে এত অসঙ্গ । প্রতীক্ষা করছে পাষাণপুরীর রাজকন্যা যেন তারই জন্যে একান্তে । তাই তার অন্বেষণ এত বিফল, তার নিভৃতি এমন নিঃশব্দ ।(বসন্তের এই গান । ২০০১)
বরং সুড়ঙ্গের কথা
বরং সুড়ঙ্গের কথা বলো :
(সুড়ঙ্গ যদি মূলে গ্রীক শব্দ হয়, ড় এল তা হলে কোথা থেকে ?) আসলে রোমক সভ্যতার কথা বলছ তুমি— ভূমিগর্ভের অন্ধ সব পয়ঃপ্রণালীর কথা ; ক্রমশ প্রসারিত হরপ্পাসংস্কৃতির কথাও । যেন জল ভাঙছে আদি জননীর জঠর । আর ছোটো ছোটো নালী এগিয়ে চলেছে নর্দমার মোহানার দিকে । আ সংস্কৃতি— এত গু মুত, এমন স্রাব পুতিগন্ধময় ; অনন্তসলিলে টলমল সহস্রদল সভ্যতা । মাথায় ঠেকে যাচ্ছে নিচু ছাদ, বাঁকা খিলান ; বুক হাঁটু নাক অবধি উঠে আসছে গাদ ক্বাথ ক্লেদের ঢেউ । তবু দুহাত দিয়ে তুমি তুলে ধরে চলেছ পলকা বুড়ি মাকে ; লঘু শিশু আর তোমার সদ্যঃসমাপ্ত অভিধানের গরিমাকেও । আলোড়িত এই নরকের ভেতর বাঁক কোথায় ? কোথায় আলো ? দান্তের নিরয়বর্ণনার শেষে নক্ষত্রে আকীর্ণ সে-অন্ধকার, নক্ষত্রে আকীর্ণ সে-অন্ধকার পুরগাতোরিওর শেষে, পারাদিসোর শেষে… (পারাদিসো যদি মূলে ফারসি শব্দ হয় তাহলে ফিরদৌসী এসেছে সেখান থেকে ) আ উদ্যান, পাখির তান, ভোরের প্রথম আলো আর হাইড্র্যান্টের ঢাকনা খুলতেই বেয়োনেট উঁচিয়ে-রাখা নাট্সি সৈন্যের অবাস্তব বিরাট বুটজুতো । না, বিস্মৃতির কথা বোলো না তুমি ।(প্রদোষের নীল ছায়া । ২০০১ )
নির্গন্থ
এককালে মষ্করী গোশালের শিষ্য ছিলাম আমি ।
তাঁর মতো নিয়তিবাদী হতে পারলাম না, এই আমার নিয়তি । ভালো লাগল না নগ্ন আজীবিকদের সঙ্গে আমৃত্যু মশকরা । হলুদ ধটী পরে দেশে ফিরে এলাম, ভাবলাম অজাতশত্রু রাজাই জাতশত্রু । ভালো লাগল না, আমাদের লিচ্ছবিবংশে রাজার সংখ্যা ৭৭০৭ । কেউ একবর্ণ সংস্কৃত জানে না, এইসব অসংস্কৃত রাজা । ভাবলাম কষায় পরব, শরণ নেব সংঘের । অবাক কাণ্ড, আশি বছরের বুদ্ধ আমাকে দিল উপসম্পদা ; আমি তার শেষ শ্রাবক । তারপর সুগত গেল, ভাবলাম ভালোই হলো । ভালো লাগল না অভিধর্ম নিয়ে আনন্দ আর উপালির বিতণ্ডা । এবার আমার ধর্ম আমার কাছে । ভেবে ফিরে গেলাম বৈশালীতে । ভেবেছিলাম প্রৌঢ় বিট হয়ে কাটিয়ে দেব দিনগুলো । কে বলেছে, বেশ করে তাই ওরা বেশ্যা । রূপবান এক অনতিতরুণকে বারবার উলঙ্গ করেও ওদের ক্ষান্তি নেই । ভাবছি তাহলে নগ্ন আজীবিকদের মধ্যে শান্তি আছে । চাইলে ভিড়ে যাওয়া চলে দিগম্বর জৈনদের দলে । হয়তো এতদিনে মস্করী গোশাল বিগত, তার বন্ধু নাকি শত্রু মহাবীরও নেই কিছুতে কিছু আসে যায় না, যাওয়া যায় গুরু সঞ্জয় বেলথিপুত্রের কাছে । পকুধ কাত্যায়নকে গুরু করে তার ককুদ নিয়ে খেলা করলে হয় । কিংবা ফেরা যায় লিচ্ছবিদের মধ্যে; অঙ্গে তোলা যায় বর্ম কবচ, মগধরাজের বিরোধিতার অঙ্গীকার । জিতে এসে বিছানায় ডাকা যায় সন্তানের মাকে; হেরে এসে সটান শুয়ে পড়া যায় শ্মশানে । ভ্রূণ হয়ে ফেরা যায় জঠরে । ভালো লাগে না, ব্রাহ্মণদের জন্মান্তরের ধারণায় আমার আস্থা নেই ।(প্রদোষের নীল ছায়া । ২০০১ )
ছড়া
বাংলা বিভক্তির মতো এখানে তীর্যক
বৃষ্টি পড়ে । ধারাপাত শিখে ভুলে যাওয়া রাঙা খেতে হাওয়া দেয় সারা রাত । শব্দের পিপাসা তোমায় জাগিয়ে রাখে । বিছন শব্দের কোনও ব্যুৎপত্তি না জেনে টের পাও ধানের ছড়ার ভেতরে কান্নার দানা । অন্ধকারে গড়ে ভেঙে গেল হাকন্দ-পুরাণ । সন্তত বর্ষার গান নামে : স্বপ্নে বোনা হয়েছিল, রোয়া হল ভিড়ে । জয় আছে অপেক্ষায়, আশা তারও পরীক্ষা রয়েছে । শিশুর বাসনালোক হতে এসো বৃষ্টি, বার হয়ে এসো ।(জলের তিলক । ২০০৩)
শেষের কবিতা
একটি বই । আরও একটি । একটির পর, একটি ।
খাড়া শিরদাঁড়া, সার-দেওয়া বইয়ের থাক । কে আবিষ্কার করল বইয়ের তাক ? পাঠাগার কার আবিষ্কার ? কাঠ থেকে কাগজ, কাঠ থেকে দরজা জানালা বইয়ের আলমারি । কাঠবেড়ালি কিছু জানে না । দারুণ সব প্রশ্ন । কাঠবেড়ালি ভাঙা আখরোটের দানা মুখে নিয়ে গাছে ওঠে, গাছ থেকে নেমে আসে । দারুণ সব প্রশ্ন । লাবণ্যও কিছু জানে না । পাতা-খোলা বলাকা-য় সকালের ওম, শিশিরের ভেজা, হাওয়া লুকোচুরি খেলে । ছায়া পড়ে অমিত রায়ের । পেছনে নিবারণ চক্রবর্তীর ছায়া । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছায়া আরও পিছনে । রবীন্দ্ররচনাবলীর অচলিত খণ্ড প্রকাশ হয় । প্রকাশ পায় প্রতিযোগিতার সুন্দরী, সোঁদামাটির সেন্ট, সাগরশীকরলিপ্ত বাতাসের সুগন্ধ । আর, শেষের কবিতা, থাকে । আরও আতিথ্য থাকে প্রেমের, আলোর ।(জলের তিলক । ২০০৩)
পুনরাগমন
পুনরাগমন ছিল প্রত্যাশায়, যদি নাও আসো
ডাকের গহনা দিলে, এ জন্যই ঋণী । সমান্তর থামগুলি মারবেলের, শিঙেতে জড়িয়ে জ্যোৎস্না হরিণেরা কোথায় পালাবে ; যথালাভ, এইখানে নৌকো থেমে যায় আয়োজনে, তোমারই গহনা তুমি যেন নিয়ে আজ উঠে আসো জলকন্যা ; কিন্নরপ্রাসাদ থেকে দৃশ্যমান মৎস্যনারী যেন আসে, তার আঁশে হাঁসের ডানার জল ঝরে যায়, কোথায় যে যাবে : নিভৃত পাথর ঘিরে ধরে আছে, সমস্ত শরীর জুড়ে শ্যাওলালতার শব্দ হয় শ্যাম শব্দ মায়াময় শব্দগুলি তার সাঁতরে পেরিয়ে গিয়ে কতদূর, ঊরু ঢাকে যেখানে চাঁদমালা, জ্যোৎস্নায় চরণচক্র চূর্ণশাদা, খচিত অঙ্গুরী ঘোরে চক্ষুময়, ওরও দূরে উঠেছিল চন্দ্রের মুকুট ? দুহাতে ঠেলেছে সব, এখন নিজের ঘোরে এত কিছু স্মৃতি ভেঙে যায় ; ভাঙে লাঞ্ছনাছলনাঘেরা অভিঘাত কঙ্কণের, তবু দূর, হাত থেকে দৃঢ় কিছু দূর তোমার প্রতিমা ওঠে একেবারে তিন সত্য স্বপ্নের মতন ।(অগ্রন্থিত কবিতা । ১৯৭০ – ২০০০)
অথবা হলুদতর সেই দেশে
অথবা হলুদতর সেই দেশে ফিরে যাব পতঙ্গ আমার ;
প্রত্যন্তে ফুটেছে ফুল, একমুখী, প্রথাসিদ্ধতার বিপরীতে থেকে থেকে ঘুরে যাব সামান্য না থেমে : চক্ষুর সময়ে ঘুরে, হরিদ্রার অবস্থান দেখাব বিকাশে দূরে, নারীদের থেকে দূর শেষদিনে, নক্ষত্রের থেকে কিছু বেশি সুদূর… ঘুরেছে বৃত্ত, স্পর্শ ক’রে চিনে গেছে কিশোর, বালক ; তবুও পত্রের মধ্যে শুষ্ক কম্পমান সুর, প্রশীর্ণ অঙ্গুলি, ফিরেছে সন্ধ্যায়, আরো সন্ধানীর মতো গ্রন্থে, ধূলিতে, আলোতে ।(অগ্রন্থিত কবিতা । ১৯৭০ – ২০০০)
সংগীত কেবল ছিল
সংগীত কেবল ছিলো কল্পনায়, আমি শুধু চর্মচোখে প্রস্বর শুনেছি
ঘাম ও পাতার রাজ্যে, ধূসর ফলের বিন্দু পরিপূর্ণ অশ্রুময়তায় চোখের পাতার থেকে রক্তের ভিতরে গেলে, শব্দ শব্দে অব্যক্ত বেদনা এত নির্জনতা, তবে এখানেই হত্যা করো গলা টিপে টিপে প্রস্ফুট রোদের রাজ্যে ; দ্বিপ্রহরে লম্বমান ছায়া ভাঁজে ভাঁজে কেন ভ্রমণের শাড়ি, দূর থেকে উড়ে আসা অভ্রান্ত গমক : দীর্ঘস্থায়ী এর নাম ? আমি কিছু না বুঝেও বেদনা বুঝেছি ; সুন্দর হাতের লেখা চেয়ে চেয়ে আঁকাবাঁকা হয়েছি আবেগে ; হত্যাকারী, আর জলে ভেঙে গেছে দীর্ঘ অবয়ব ; তবে কী বেদনা ছিল, জলের চারদিকে ছিল গোল গোল দাগ অভ্রান্ত গলার… আমি সঙ্গে গিয়ে তবু কোনো সংগীত শুনি নি : শব্দের সম্মুখে থেকে বুঝে গেছি স্বরাঘাত, হত্যার বেদনা ।
দারুণ স্বর্ণেন্দু। অসম্ভব ভালো কাজ।
LikeLike
Koushikda, valo laglo, tumi porle….motamot janale. ….
LikeLike